করোনা ভাইরাস সম্পর্কে দুই বন্ধুর মধ্যে এমন একটা কথোপকথন
—কী রে, দেখেছিস পোস্টটা?
—কোনটা বল তো?
—আরে, এই করোনাভাইরাসের কথা নাকি আগেই বলে দিয়েছিল একটা উপন্যাসে। দেখিসনি এখনও? আমি শেয়ার করেছি আমার ওয়ালে। দেখে নে।
দুই বন্ধুর মধ্যে এমন একটা কথোপকথন যে নেহাত কল্পনা নয়, তা নেটিজেনমাত্রই বিশ্বাস করবেন।
দিনের একটা বড় সময় ইন্টারনেট সার্ফিং করলে, ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা টুইটারে একটি বইয়ের পাতার ছবি ঘুরছে, যেখানে নাকি এই করোনাভাইরাস নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
প্রশ্নটা হচ্ছে, ‘ফ্যাক্ট’ না ‘ফিকশন’—কোনটাকে গুরুত্ব দেবেন? আজ্ঞে হ্যাঁ। এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে ১৯৮১ সালে লেখা একটি উপন্যাসকে কেন্দ্র করে। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল, এই উপন্যাসেই নাকি করোনাভাইরাস নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী ছিল। সত্যিই কি তাই? আসুন দেখা যাক কোনটা ‘ফ্যাক্ট’ আর কোনটা ‘ফিকশন’।
১৯৮১ সালে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘দ্য আইজ অফ ডার্কনেস’-এ আমেরিকান লেখক ডিন কুন্টজ নাকি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কী বলেছিলেন তিনি? ২০১৯-২০২০ সালে এমনই অতিমারী হতে চলেছে বিশ্বে, যার মূলে রয়েছে একটি ভাইরাস। ১৯৮১ সালে লেখা উপন্যাসে সেই ভাইরাসের নাম ছিল ‘গোর্কি ৪০০’। রাশিয়ার একটি অঞ্চলের নামে। পরে, ১৯৮৯ সালে বইটি ফের প্রকাশিত হলে ভাইরাসের নাম বদলে রাখা হয় ‘উহান ৪০০।’ এই খবর টুইটার বা ফেসবুকে কয়েক লক্ষবার শেয়ার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সব চেয়ে বেশিবার ওই বইয়ের যে পাতা শেয়ার হয়েছে, তা বলছে, ‘…ওরা এই ভাইরাসকে বলছে ‘উহান ৪০০’। কারণ, এটা তৈরি করা হয়েছিল উহানের বাইরে আরডিএনএ ল্যাবে। এর মধ্যে মানুষের তৈরি ৪০০ মাইক্রোঅরগানিজমের স্ট্রেন রয়েছে।’ এর সঙ্গে আরও একটা পাতা অনেকেই শেয়ার করেছেন, যা বলছে ২০২০ সালে নাকি নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ মহামারীর আকার নেবে।
প্রশ্ন ওঠে, যা শেয়ার করা হচ্ছে, তার সবই কি সত্যি?
উত্তরে বলা যায়, কিছুটা সত্যি। এবং কিছুটা নয়।
কী রকম?
ডিন তাঁর উপন্যাসে কাল্পনিক একটি ভাইরাসের যে উল্লেখ করেছিলেন, তা সত্যি। এবং, এটাও সত্যি যে, এই ভাইরাসের নাম (উহান ৪০০) চিনের এমন একটি শহরের নামে, যেখান থেকেই কোভিন ১৯ প্রথম ছড়িয়েছিল। কিন্তু, ডিনের উপন্যাসের বয়ান বলছে, এই ভাইরাস মানুষের তৈরি। এবং, তা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে।
‘ফিকশন’ যা-ই বলুক, ‘ফ্যাক্ট’ বলছে, কোভিড-১৯ যে ল্যাবে তৈরি, তার কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তথ্য বলছে, উহানের একটি মাংসের বাজার থেকে প্রথম এই ভাইরাস ছড়ায়। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বাদুড় থেকেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছিল।
পার্থক্য আরও রয়েছে।
ডিনের উপন্যাসে বলা হয়েছে, ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ২৪ ঘণ্টার বেশি কেউ বেঁচে থাকতে পারবেন না। অনেকেই ১১ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাবেন—এমনটাই লিখেছিলেন ডিন। কিন্তু বাস্তব বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যু হার তেমন নয়। হু-র দেওয়া একটি হিসেব বলছে, উহানে মৃত্যুর হার ২ থেকে ৪ শতাংশ।
আরও ফারাক রয়েছে।
কী রকম?
উপন্যাস বলছে ‘উহান ৪০০’-এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড মাত্র চার ঘণ্টা। অথচ, বাস্তব বলছে, করোনা ভাইরাসে ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১ থেকে ১৪ দিন। হু-এর মতে, ন্যূনতম ৫ দিনের মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া বোঝা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
ডিন উপন্যাসে বলেছেন, ‘উহান ৪০০’ ইবোলা ভাইরাসের থেকেও মারাত্মক। কিন্তু, বাস্তব তেমনটা বলছে না। হু-র হিসেব বলছে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশ। কিন্তু, বাস্তব তেমনটা বলছে না, এমনকী কোভিডে মৃত্যুর হার ইবোলার থেকেও কম।
তা বলে শেষ বিচারে কী বলতে হবে?
ডিন তাঁর উপন্যাসে অবশ্যই ‘উহান ৪০০’ নামে একপ্রকারের ভাইরাসের কথা লিখেছিলেন। কিন্তু, তার বর্ণনার সঙ্গে বর্তমানে করোনাভাইরাসের তেমন কোনও মিলই নেই।
বুঝলেন তো, ‘ফ্যাক্ট’ এবং ‘ফিকশন’-এর ফারাকটা ঠিক কোথায়?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন